ব্যবসায় পরিবেশ কি? ব্যবসায় পরিবেশের উপাদানসমূহ

 

ব্যবসায় পরিবেশ কি? ব্যবসায় পরিবেশের উপাদানসমূহ

শিল্পোদ্যোগের উপর নানাভাবে বিভিন্ন উপাদানসমূহ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। বিভিন্ন লেখক ও গবেষকগণ শিল্পোদ্যোগের উপর পরিবেশের প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে অসংখ্য ব্যবসায় পরিবেশের উপাদান চিহ্নিত করেছেন। যেমন-

নাউমস্ (Naums) এর মতে, “যে-সকল উপাদান শিল্পোদ্যোগকে প্রভাবিত করে তন্মধ্যে অর্থসংস্থানের বহিঃসমর্থন, প্রযুক্তিবিদ্যা, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন ক্ষমতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

ভেসপার ও আলবাউম (Vesper and Albaum) বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা উল্লেখ করেন, যথা- অভ্যন্তরীণ বাজার, কৃত্রিম উৎপাদন, শিল্প, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন শ্রমশক্তি, গবেষণা ও পরীক্ষাগার, সরকারি ও বেসরকারি গবেষণাগার, মূলধনের উৎস এবং সরকারি সহযোগিতা একজন নতুন শিল্পোউদ্যোক্তাকে প্রভাবিত করে। এ ধরনের অনেক গবেষক ও লেখক এ ধরনের বহু উপাদানসমূহ চিহ্নিত করেছেন।

ব্যবসায় পরিবেশ কি?

ব্যবসায় পরিবেশ বলতে ঐসব পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিকে বুঝানো হয়, যা প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলী, কার্যপ্রয়োগ বা সিদ্ধান্তসমূকে প্রভাবিত করে।

ব্যবসা একটি আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠান। ব্যবসায়ের যে-সব বহিঃস্থ পারিপার্শ্বিক অবস্থা উদ্যোক্তার ব্যবসায় বা শিল্পের প্রবর্তন ও কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে, তাকে ব্যবসায় পরিবেশ বলে অভিহিত করা হয়।

কোনো এলাকার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, আইনগত ও প্রযুক্তিগত পরিবেশ ব্যবসায়-বাণিজ্য তথা ব্যবসায় উন্নয়নে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। এগুলোকে ব্যবসায় পরিবেশের উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। এ উপাদানগুলোই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সংগঠন, নীতিনির্ধারণ; সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। নিম্নে ব্যবসায় পরিবেশের জনপ্রিয় উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা দেওয়া হলো- 

(i) ফিলিপ কটলার (Philip Kotler) -এর মতে, “ব্যবসায় পরিবেশ হলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী সকল প্রকার শক্তি।”

(II) অধ্যাপক এন.সি. রায় চৌধুরী -এর মতে, “যে-সব অবস্থা ব্যবসায়ের উন্নয়নের উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে, তাকে ব্যবসায়িক পরিবেশ বলে।

সুতরাং বলা যায়, ব্যবসায় পরিবেশ হলো এমন সব শক্তি ও পারিপার্শ্বিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত অবস্থা, যা ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে।

ব্যবসায় পরিবেশের উপাদানসমূহ কি কি?

ব্যবসায় পরিবেশের অভ্যন্তরীণ উপাদান কোনটি? নিম্নে ব্যবসায় পরিবেশের অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলো তুলে ধরা হলঃ

(১) রাজনৈতিক পরিবেশ (Political environment)

(২) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ (Socio-cultural environment)

(৩) অর্থনৈতিক পরিবেশ (Economical environment)

(৪) আইনগত পরিবেশ (Legal environment)

(৫) প্রযুক্তিগত পরিবেশ (Technological environment)

ব্যবসায় পরিবেশের উপাদানসমূহের বিস্তারিত আলোচনা

নিম্নে শিল্পোদ্যোগ পরিবেশকে প্রভাব বিস্তারকারী প্রধান প্রধান উপাদানগুলো বর্ণনা করা হলো-

১। রাজনৈতিক পরিবেশ

ব্যবসায় পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল রাজনৈতিক পরিবেশ। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের উপর শিল্পোদ্যোগের ধনাত্মক সম্পর্ক রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ যদি স্থিতিশীল ও অনুকূল হয়, তবে উদ্যোক্তাগণ নতুন নতুন শিল্পে উৎসাহিত হন। 

যদি রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল হয় এবং শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করে, তবে উদ্যোক্তাগণ শিল্পবিমুখ হয়ে পড়েন। কারণ, তখন দেশে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয় ও আইনের শাসন ভেঙে পড়ে। ফলে উদ্যোক্তাগণ বিনিয়োগে উৎসাহিত হন না। তাই বলা যায়, রাজনৈতিক পরিবেশ দ্বারা শিল্পোদ্যোগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।

২। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ

প্রতিটি দেশে বা অঞ্চলেই তাদের নিজস্ব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ বিরাজ করে। একটি দেশের জনসাধারণের আচার-আচরণ, ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সহনশীলতা ও যে-সকল কর্মকাণ্ড প্রচলিত আছে, তাদের সমষ্টিই হলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ। 

একজন উদ্যোক্তার উদ্যোগ গ্রহণ বহুলাংশেই এ সকল উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। যেমন- পশ্চিমা দেশসমূহে মদ্যপান সমাজের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে; ফলে, সেখানে মদ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে উদ্যোক্তার অভাব নেই। 

পক্ষান্তরে, আমাদের দেশ তথা মুসলিম দেশগুলোর জন্য এটা সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থি বিধায় এ ধরনের ব্যবসায়ের প্রসার ও প্রচার একেবারেই সীমিত। 

তাই বলা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি হয় বাধার সৃষ্টি করছে নতুবা উৎসাহিত করছে। এভাবেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ শিল্পোদ্যোগের উপর প্রভাব সৃষ্টিকারী গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে গণ্য হচ্ছে।

৩। অর্থনৈতিক পরিবেশ

অর্থনৈতিক পরিবেশ বলতে একটি অঞ্চল বা দেশের মানুষের আয়, সঞ্চয়, মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রাসংকোচন, উন্নত পুঁজিবাজার, শেয়ার বাজার, পণ্য বাজার প্রভৃতিকে বুঝিয়ে থাকে। এগুলো একজন উদ্যোক্তাকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করে আবার অনেক ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে থাকে। 

যদি জনগণের আর্থিক অবস্থা ভালো থাকে, তবে ভোগ ও ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। রুচির পরিবর্তন হয় বলে নতুন ও উন্নতমানের পণ্য ক্রয়ে আগ্রহ জন্মায়, যার ফলে নতুন নতুন শিল্প স্থাপনে উদ্যোক্তাগণ আগ্রহ প্রকাশ করে। অনুকূল অর্থনীতির ফলে বিভিন্ন উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণ বিনিয়োগে উৎসাহবোধ করে। ফলে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়। 

পক্ষান্তরে, মানুষ আর্থিক অসচ্ছলতায় পড়লে ও মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে ধীরে ধীরে ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে উদ্যোক্তাগণ নতুন কোনো উদ্যোগ গ্রহণে উৎসাহ পান না। শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিবেশের প্রভাবও শিল্পোদ্যোগের উপর পড়ে। তাই বলা যায় যে, শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিবেশ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

৪। আইনগত পরিবেশ

একটি সমাজে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বসবাস করতে হলে কতকগুলো রীতিনীতি, প্রথা, নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। এ সকল রীতিনীতি ও নিয়মকানুনকে আইনগত পরিবেশ বলে। 

যে-কোনো দেশের জন্য আইনগও পরিবেশ শিল্পোদ্যোগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ব্যবসা-বাণিজ্যে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্যে সারা পৃথিবীতেই শিল্প ও শ্রমিক আইন প্রণীত হয়েছে। 

আবার কিন্তু কিছু দেশে পৃথক বাণিজ্যিক আদালতও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশে যদি শুধু আইনকানুন ও তার যথাযথ প্রয়োগের ব্যবস্থা কার্যকর থাকে, তবে শিল্পে নতুন নতুন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। দেশের সরকার ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষার্থে সুষ্ঠুভাবে আইন প্রয়োগ করলে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। 

সুতরাং বলা যায় যে, আইনগত পরিবেশ এমন একটি ব্যবসায় পরিবেশের উপাদান, যা শিল্পোদ্যোগের জন্য আইনগত পরিবেশ যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।

৫। প্রযুক্তিগত পরিবেশ

প্রযুক্তি আধুনিক বিজ্ঞানের ফসল। আর যে দেশ প্রযুক্তিতে যত উন্নত, সে দেশ শিল্পকারখানাতেও তত বেশি উন্নত। প্রযুক্তি একটি দেশের জন্য বিপ্লব বয়ে আনতে পারে। নতুন নতুন প্রযুক্তি মানুষকে আরো শিল্পোদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করছে। নতুন ও উন্নত প্রযুক্তির ফলে কম সময়ে বেশি লাভজনক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এতে ভোক্তারা কম দামে দ্রব্য পাওয়ার ফলে তাদের ভোগ প্রবণতা বেড়েছে, ফলে চাহিদাও বেড়েছে। এজন্য প্রয়োজন হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোগের। 

তাই বলা যায়, প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে শিল্পোদ্যোগের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। তাই দিন দিন উদ্যোক্তাদের প্রসারও ঘটছে প্রচুর পরিমাণে। 

উপরের আলোচনা থেকে বলা যায় যে, দেশের শিল্পোদ্যোগের উপর রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, আইনগত ও প্রযুক্তিগত পরিবেশগুলো অনুকূলে আনার জন্য সরকার আইনগত, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও শিল্পনীতিসহ বিভিন্ন সংস্কার কার্য হতে নিয়ে থাকে; যাতে করে দেশি ও বিদেশি উদ্যোক্তাদেরকে বেশি বেশি সুযোগ সৃষ্টি করে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা যায়

Post a Comment

Previous Post Next Post