ভাবসম্প্রসারণঃ কী? বৈশিষ্ট্য, প্রয়োজনিয়তা, লেখার নিয়ম।

ভাবসম্প্রসারণ

ভাবসম্প্রসারণ

এই আর্টিকেলটি পাঠ করে আপনারা যা শিখবেনঃ ভাব-সম্প্রসারণ কী? ভাব-সম্প্রসারণের বৈশিষ্ট্য? ভাবসম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা? ভাব-সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া বা লেখার নিয়ম। লেখার সময় যে সকল বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।

→ ভাব-সম্প্রসারণ কী?

ভাবের সুসঙ্গত সার্বক প্রসারণই হলো ভাবসম্প্রসারণ। স্বল্প পরিসরে গদ্য কিংবা পদাবন্ধে প্রকাশিত কোনো বিশিষ্ট ভাবকে মননকল্পনা সহযোগে প্রাসঙ্গিকতাসহ শিল্প-সুষমামণ্ডিত ভাষায় বিস্তৃত করে পরিবেশন করাকে ভাবসম্প্রসারণ বলে। গভীর ভাবের বিন্দুকে সহজ ভাষায় বিস্তার সাধন করার নামই ভাব-সম্প্রসারণ।

→ ভাব-সম্প্রসারণের বৈশিষ্ট্য

ইংরেজি Amplification-এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো ভাব-সম্প্রসারণ। ভাবসম্প্রসারণ কথাটি নিজেই তার নিহিতার্থের আভাস দেয়। কোনো ভাবের সম্যক এবং বিশদ প্রসারই হলো ভাব-সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য। 

বীজ যেমন মাটি, জল, আলো এবং বাতাসের সহযোগিতায় নিজেকে শাখা-প্রশাখা, পাতায় ফুলে-ফলে পরিব্যাপ্ত করে পূর্ণতা পায়, ভাব-সম্প্রসারণেও তেমনি বীজরূপী কোনো বিশিষ্ট ভাব চিন্তা-ভাবনা-কল্পনার সাহায্যে এবং শিল্পিত ভাষার সংস্পর্শে সম্প্রসারিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে।

অনেক সময় দেখা যায়, জীবনের মহৎ উপলব্ধি লেখকের লেখনীতে স্বল্পকথায় ইঙ্গিতময় রূপে প্রকাশ পায়। মহৎ ভাব বা চিন্তা যে আকারে সবসময় বিরাট হবে, এমন কোনো কথা নেই। বিন্দুতে সিন্ধুর মতো জীবনের অনেক বড় ভাবও ছোট পরিসরে ধরা পড়ে।

আবার জগৎ ও জীবন সম্পর্কে আমাদের দার্শনিক উপলব্ধি কখনো কখনো সামান্য কথায় ব্যক্ত হয়। ইঙ্গিত এবং ব্যঞ্জনাধর্মী এসব মিত-আয়তনের কথাকে সম্প্রসারিত করাই ভাব-সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য। লেখক তার বক্তব্য বিষয়কে সুন্দর করার জন্যে অর্থবহ করে ভাবের রূপ দেন। উপযুক্ত উপমা দিয়ে রসালো করে কবি-সাহিত্যিকগণ যে বিষয় রূপায়িত করেন, তার বক্তব্য অনেক সময় সব পাঠকের কাছে সহজভাবে ধরা পড়ে না। এ অবস্থায় ভাবটিকে যদি সহজ করে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যায় তবে সকলের পক্ষেই তা বোঝা সম্ভব। ভাব-সম্প্রসারণ সে উদ্দেশ্যকে সফল করে তোলে।

→ ভাব-সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা

ভাব-সম্প্রসারণের মাধ্যমে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সাংকেতিক ভাবটির ওপর আলোকসম্পাত করে তার স্বরূপ সন্ধান করা যায়। সেটা করতে গিয়ে বুঝতে পারা যায়, মূলভাবটি আসলে মানবজীবনের কোনো মহৎ আদর্শ, মানবচরিত্রের কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য, নৈতিক কোনো বিচ্যুতি কিংবা এরকম কোনো তাৎপর্যময় ব্যঞ্জনাকে ধারণ করে আছে। ছোট আকারের কথার মধ্যে গভীর ভাব ফোটানোই লেখকের কৃতিত্ব। কিন্তু পাঠককে তা খুঁজে বের করতে হয়। ভাব খোঁজার এই কাজটি সহজ করার জন্যেই ভাবসম্প্রসারণ। 

ভাবের ব্যঞ্জনা ইঙ্গিতের বাইরে এনে ভাব-সম্প্রসারণের মাধ্যমে মূলকথা প্রকাশ করা এর উদ্দেশ্য। ভাব-সম্প্রসারণের মাধ্যমে বক্তব্য বিষয় সহজে পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এতে বিবরের জটিলতা দূর হয় এবং পাঠক বক্তব্যের অর্থ বুঝতে পারে। তাই ভাব- সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

→ ভাবসম্প্রসারণ লেখার নিয়ম।

ভাব-সম্প্রসারণের কাজটি যথাযথ ও বিশদভাবে করতে হলে কিছু প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। তাই ভাব-সম্প্রসারণের সময় শিক্ষার্থীদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত থাকা প্রয়োজন।

১। ভাব-সম্প্রসারণের কাজটি শুরু করার আগে মূল রচনাটি বারবার পড়া উচিত, তা না হলে গদ্যের কোনো বাক্য বা কবিতার চরণে নিহিত অর্থ সম্পর্কে ধারণা স্বচ্ছ হবে না। অনেক সময় দেখা যায়, আপাতদৃষ্টিতে মূল ভাবটির যে অর্থ প্রতীয়মান হচ্ছে বারবার পড়লে সেই অর্থের তাৎপর্য আরো গভীরভাবে ধরা পড়ছে। তাই মূলভাবটির বিষয়ে স্পষ্ট এবং সঠিক ধারণা গড়ে তোলার জন্যে মূল রচনাটি একাধিকবার পাঠ করা বাঞ্ছনীয়। 

২। মূল রচনার লেখকের নাম জানা থাকলেও ভাবসম্প্রসারণে তা উল্লেখ করা যাবে না।

৩। মূল রচনার বিশদ বিষয়টি শিক্ষার্থীর জানা থাকলেও কখনোই ব্যাখ্যার মতো ভাব-সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কোনো পূর্ব প্রসঙ্গের উল্লেখসহ তার আলোচনা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৪। মূল রচনাটির প্রত্যেকটি শব্দই যেহেতু ব্যঞ্জনাধর্মী, সেহেতু প্রদত্ত রচনার শব্দপ্রয়োগের বিষয়ে শিক্ষার্থীকে অনুসন্ধিৎসু হতে হবে। সেই সাথে মূল ভাবকে শব্দগুলো কীভাবে ব্যঞ্জিত করছে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

৫। মূল রচনায় রূপক–উপমাদি থাকলে সেগুলোর বিশ্লেষণ এবং প্রয়োগ সার্থকতা যাচাই করে তার অন্তর্নিহিত প্রচ্ছন্ন ভাবটির মর্মকথা উদ্ধার করতে হবে। মূল ভাবটি আবরণমুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীর কাছে যত স্পষ্টতর হবে ততই তার ভাব-সম্প্রসারণ কর্মটি সঠিক হবে।

৬। মূল ভাবটি সুস্পষ্ট হলেই শিক্ষার্থী ভাব-সম্প্রসারণে ব্রতী হবে। ভাব-সম্প্রসারণের সময় চিন্তা-ভাবনা এবং কল্পনাশক্তিকে যথাসাধ্য প্রয়োগ করতে হবে। ভাব-সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী মূলভাবের অনুসরণ করলেও তাকে বিস্তৃততর করার জন্যে মনন এবং কল্পনার স্বাধীনতা অবশ্যই গ্রহণ করবে, তা না হলে ভাবের সম্প্রসারণ ঘটবে না। তবে এই স্বাধীনতা যেন মূল রচনায় উল্লেখ করা হয়নি এমন কোনো বিষয় বা দৃষ্টান্ত ব্যবহার ভাবের প্রাসঙ্গিকতা লঙ্ঘন না করে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

৭। মূল ভাবের সম্প্রসারণের খাতিরে শিক্ষার্থী প্রসঙ্গক্রমে মূল রচনায় উল্লেখ করা হয়নি এমন কােনো বিষয় বা দৃষ্টান্ত ব্যবহার করতে পারে। এতে সম্প্রসারিত অংশটি ঐশ্বর্যবান হয়।

৮। ভাব-সম্প্রসারণের ভাষা হবে অবশ্যই গদ্য। তবে প্রত্যক্ষ উক্তি বর্জন করা বাঞ্ছনীয়।

৯। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, চিন্তা কল্পনার স্বাধীনতার নামে শিক্ষার্থী অতিরিক্ত আবেগ-উচ্ছাস ত্যাগ করতে পারে না। তাই চিন্তা কল্পনার বাহুল্য যাতে না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

১০। ভাব-সম্প্রসারণে অনুচিত বাক-বিস্তার বা অবাঞ্ছিত উপমা-অলঙ্কার প্রয়োগ কাঙ্ক্ষিত নয়।

১১। মূল ভাবটিকে সমৃদ্ধ করার জন্যে প্রাসঙ্গিক কোনো বিষয়ের অবতারণার মতো কোনো মহাপুরুষের বিখ্যাত উক্তি বা কবিতার দু-চারটি পঙক্তি উদ্ধৃত করা যেতে পারে। এতে সম্প্রসারিত বিষয়টি আকর্ষণীয় হয়। তবে উদ্ধৃতিটি যাতে নির্ভুলভাবে প্রযুক্ত হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

১২। শুধু মূলভাবের সম্যক প্রসার ঘটলেই ভাব-সম্প্রসারণের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না, প্রসারিত অংশ যাতে সাহিত্য শ্রীমণ্ডিত হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। ভাষার মনোহারিত্ব, বাক্‌বিন্যাসের চমৎকারিত্ব ভাবসম্প্রসারণকে আকর্ষণীয় করে তোলে।

 ১৩। ভাব-সম্প্রসারণের আয়তন কতখানি হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না। মূল ভাবের গুরুত্ব অনুযায়ী সম্প্রসারিত অংশের আয়তনের তারতম্য ঘটে। মনে রাখতে হবে, ভাব-সম্প্রসারণ রচনা নয়।

১৪। ভাব-সম্প্রসারণে মূল অংশটি আলোচনার সাহায্যে যথেষ্ট বাড়াতে হয়। এই বাড়ানোর সময় যাতে অপ্রয়োজনীয় কথা ভিড় না করে সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখতে হবে। বড় করতে হবে বলে আলোচনায় অপ্রয়োজনীয় কথা সংযোজন করার দরকার নেই।

১৫। আলোচনার সময় এক একটি ভাব নিয়ে এক একটি অনুচ্ছেদ রচনা করতে হবে। সবটুকু অংশ যাতে একাধিক অনুচ্ছেদে ভাগকরা যায় সেদিকে লক্ষ করা উচিত।

১৬। ভাব-সম্প্রসারণের সময় ভাবের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

ভাবসম্প্রসারণের শ্রেণিবিভাগ

গঠনের দিক থেকে ভাব-সম্প্রসারণকে প্রধানত তিনটি অংশে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন :

১. মূলভাবঃ এই অংশে অর্থাৎ শুরুতে সুনির্বাচিত ও আকর্ষণীয় ভাষায় মূলভাবটিকে পরিবেশন করতে হবে।

২। মূলভাবের বিস্তারঃ এই অংশে অর্থাৎ দ্বিতীয় স্তরে মূলভাবটিকে বিশদভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।

৩. মন্তব্য বা উপসংহারঃ এটি ভাব-সম্প্রসারণের সর্বশেষ স্তর বা অংশ। একে সম্প্রসারিত অংশের মন্তব্য বা উপসংহার বলা যায়। এ অংশে শিক্ষার্থীর মূলভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো নিজস্ব বক্তব্যকেও খুব সংক্ষেপে প্রকাশ করা যায়। আজ এই পর্যন্তই। লেখাটি ভালো লাগলে বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন।

Post a Comment

Previous Post Next Post